শীত আসার সাথে সাথে পোশাকের ধরনেও পরিবর্তন আসে। শীতের দিনে আরাম আর স্টাইল একসঙ্গে চাইলে পঞ্চো (Poncho) হতে পারে একটি দারুণ পছন্দ। এই ঢিলেঢালা পোশাকটি কারো কাছে শালের (Shawl) বিকল্প। যদিও পঞ্চো শালের চাইতেও বেশি স্টাইলিশ বলে মানেন অনেকে। এই শীতেও পঞ্চো উঠে এসেছে ট্রেন্ডের শীর্ষে।
পঞ্চো কী?
পঞ্চো হলো একটি বিশেষ ধরনের ঢিলেঢালা পোশাক, যার মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর পাঁচটি কোনা। এ কারণেই এর নাম রাখা হয়েছে “পঞ্চো।” সাধারণত এই পোশাকটি এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে মাথার অংশ ছাড়া শরীরের প্রায় পুরোটাই ঢেকে রাখা যায়। পঞ্চো অনেক ঢিলেঢালা তাই এটি পরে চলাফেরা করা অনেক আরামদায়ক। শীতে পঞ্চো শুধু গরমভাবই দেয় না, বরং এটি ফ্যাশনেবল লুকও এনে দেয়। এই কারণেই আজকাল পঞ্চো তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সকল বয়সীদের মাঝেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের কাপড় ও ডিজাইনে পঞ্চো পাওয়া যায়। উলের পঞ্চো যেমন শীতকালে ঠান্ডা কাটাতে পারে, আবার জর্জেট বা খাদির পঞ্চো পার্টিতে বেশ মানিয়ে যায়।
বিশ্বজুড়ে পঞ্চোর ইতিহাস
পঞ্চোর ইতিহাস বহু পুরোনো। এটি মূলত দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাঝে জনপ্রিয় ছিল। ধারণা করা হয়, আন্দিজ পর্বতমালার ইনকা সম্প্রদায়ের মানুষেরা প্রথম এই পোশাকটি ব্যবহার শুরু করেন। এই এলাকার শীতল আবহাওয়ায় গরম ভাব আনতে পঞ্চো ছিল খুবই উপযোগী। পঞ্চোর আদিবাসী সংস্কৃতিতে বিশেষ স্থান থাকায় এটি অনেক উৎসব, আচার-অনুষ্ঠান এবং রীতি-নীতির অংশ হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
বিগত শতাব্দীতে পঞ্চো জনপ্রিয়তা পায় লাতিন আমেরিকার বাইরে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এটি ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ফ্যাশনে প্রবেশ করে এবং বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পায়। বিভিন্ন সময়ে ফ্যাশন ডিজাইনাররা এতে আধুনিক কাট এবং নকশার সংযোজন করেন। এভাবে পঞ্চো কেবল শীতের পোশাক (Winter Collection) হিসেবেই নয়, বরং একটি ফ্যাশনেবল পোশাক হিসেবেও সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে পঞ্চোর প্রবেশ ঘটে মূলত গ্লোবাল ফ্যাশনের সাথে তাল মেলাতে। ২০০০ দশক থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পঞ্চোর প্রচলন (Poncho Collection in Bangladesh) শুরু হয়। তখনকার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে স্টাইলিশ অথচ আরামদায়ক পোশাকের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে, এবং শীতকালে পঞ্চো একটি স্টাইলিশ ফ্যাশনে রূপ নেয়। স্থানীয় ফ্যাশন হাউসগুলোও এই চাহিদা পূরণের জন্য দেশীয় কাপড় ও নকশার মিশ্রণে বিভিন্ন ডিজাইনের পঞ্চো বাজারে আনে, যা গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো খাদি, লিলেন, জর্জেট এবং সুতির মতো কাপড়ে পঞ্চো তৈরি করছে, যা স্টাইলিশ এবং আবহাওয়া উপযোগী।
পঞ্চো এবং সোয়েটারের মধ্যে পার্থক্য
পঞ্চো এবং সোয়েটার উভয়ই শীতকালের জন্য উপযুক্ত পোশাক হলেও এদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সোয়েটার (Sweater) সাধারণত হাতাসহ টাইট ফিটিংয়ের হয়, যা শরীরকে উষ্ণ রাখে। পঞ্চো ঢিলেঢালা, যা সাধারণত হাতা ছাড়া হয় এবং এটি শুধু উষ্ণতাই নয়, ফ্যাশন স্টেটমেন্ট তৈরিতেও ভূমিকা রাখে। সোয়েটার মূলত উল, কটন বা অ্যাক্রিলিক দিয়ে তৈরি হয়, যেখানে উল ছাড়াও খাদি, লিলেন, জর্জেট এবং সিল্কের মতো বিভিন্ন কাপড়ে পঞ্চো তৈরি হয়। সবচেয়ে বড় পার্থক্যের জায়গা হলো যে, সোয়েটার শুধু শীতের পোশাক হিসেবেই রয়ে গেছে। কিন্তু কাপড়ের ধরণ বদলে নিলেই পঞ্চো পরা যায় বছরজুড়ে।
নারীদের জন্য শীতের পঞ্চো
শীতে নারীদের জন্য পঞ্চো (Women winter Poncho) একটি আধুনিক পোশাক। এটি যেমন আরামদায়ক, তেমনি স্টাইলিশ। বাজারে বিভিন্ন ডিজাইন ও রঙের পঞ্চো পাওয়া যায়, যা জিন্স (Jeans), ট্রাউজার বা শাড়ির (Saree) সাথে সহজেই মানিয়ে যায়। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোতেও মেয়েদের জন্য লেস, ফার, এমব্রয়ডারি, ব্লক প্রিন্ট সহ নানা ডিজাইনের পঞ্চো পাওয়া যায়।
এ বছর পঞ্চোর ট্রেন্ড
এই শীতে পঞ্চোতে কিছু নতুন এবং আকর্ষণীয় ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। যেমন:
রঙিন পঞ্চো
বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙের মিশ্রণে তৈরি পঞ্চো এই শীতে বেশ জনপ্রিয়। রঙিন পঞ্চো শীতের পোশাকে আনে নতুন উজ্জ্বলতা। এই শীতে অ্যাজটেক মোটিফের পঞ্চোগুলো সবার পছন্দের শীর্ষে উঠে এসেছে।
নিটেড পঞ্চো
শীতে আরাম আর গরম দেওয়ার জন্য আদর্শ পোশাক নিটেড পঞ্চো। ক্যাজুয়াল টপ-টি-শার্ট (Tops-T-Shirt) ও জিন্সের কম্বোর ওপরে যেমন ভালো লাগে, তেমনি প্রতিদিনের সাধারণ টিউনিকের (Tunic) ওপরে চাপিয়ে নিলেও দারুণ দেখায়। আজকাল শাড়ির ওপরেও পঞ্চো চাপিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে অনেককেই।
ফ্রিঞ্জড ও ফার পঞ্চো
ফ্রিঞ্জ বা ঝুলযুক্ত ও ফার এটাচ পঞ্চো এই শীতের ট্রেন্ডে আছে। এটি শীতের পোশাকে ভিন্নতা আনে এবং একটি আকর্ষণীয় লুক তৈরি করে।
প্যাটার্নড পঞ্চো
ডায়মন্ড, স্ট্রাইপ, চেক, কিংবা ফ্লোরাল ডিজাইনের প্যাটার্নড পঞ্চোগুলো এবারের ফ্যাশনে নতুন বৈচিত্র্য যোগ করেছে। শীতে ভিন্ন ধরণের স্টাইল পছন্দ করলে এটি দারুণ একটি অপশন।
হুডেড পঞ্চো
হুডযুক্ত পঞ্চো শীতের জন্য বেশ কার্যকরী। যাদের মাথায়, কানে ঠান্ডা বেশি লাগে, বিশেষ করে শিশুদের জন্য হুডেড পঞ্চো একটি দারুন অপশন।
বাংলাদেশে পঞ্চোর দাম
বাংলাদেশের ফ্যাশন হাউসগুলোতে বিভিন্ন কাপড় ও ডিজাইনের পঞ্চো (Poncho Collection) পাওয়া যায়, আর সেগুলোর দাম কাপড়, নকশা ও মানভেদে পরিবর্তিত হয়। সাধারণত সুতি এবং খাদি কাপড়ের পঞ্চোর দাম ১২০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে থাকে। তবে শীতের জন্য বিশেষভাবে তৈরি নিটেড (knit) পঞ্চো, ফার-যুক্ত, জর্জেট, সিল্ক বা রেশমি সিল্কের মতো জমকালো কাপড়ের পঞ্চো দাম কিছুটা বেশি হয়। ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় এই পঞ্চোগুলি, যা দাওয়াত বা পার্টির জন্য বেশ মানানসই।
দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর পাশাপাশি লোকাল মার্কেটেও বিভিন্ন মানের পঞ্চো পাওয়া যায়। এখানে দাম একটু কম হয়ে থাকে, প্রায় ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে ভালো মানের পঞ্চো পেয়ে যাবেন, যা দৈনন্দিন ব্যবহার এবং ফ্যাশনের জন্যও পারফেক্ট।
শীতের পোশাকের ভিড়ে পঞ্চো আজকের ফ্যাশনসচেতন মানুষের এক বিশেষ পছন্দ। বিভিন্ন ডিজাইন ও কাপড়ের মিশ্রণে তৈরি এই পোশাকটি কেবল শীতের ঠান্ডা থেকে রক্ষা করেই নয়, সারা বছরই এটি বেশ মানানসই। জিন্স, লেগিংস বা শাড়ির সঙ্গেও সহজে মানিয়ে যায় বলে পঞ্চো প্রতিদিনের জন্যও অসাধারণ একটি পছন্দ। তাই এবারের শীতকে আরেকটু রঙিন এবং আরামদায়ক করতে আপনার পছন্দের পঞ্চোটি বেছে নিন আজই।
- ফাতেমাতুজ্জোহরা আফিয়া